জীবনভগ্নাংশ-১

মানুষটা বয়স্ক নয়। গলাটা বেশ গম্ভীর মনে হলো। কখনও কখনও কথার গুরুত্ব বুঝাবার জন্য অনেকে গম্ভীর স্বরে কথা বলে থাকে। উনার কথাটা তেমন ধাঁচেরই মনে হলো।

  • লোকজনকে বিশ্বাস করে বাঁশ খেয়েছেন প্রচুর!
    বান্দরবন অঞ্চলে বেড়াতে গেলে একথার একটা ভিন্ন মানে থাকতো। কিন্তু এখানে বিষয়টা একদমই আলাদা। আমার বিশ্বাসকে উড়িয়ে দিয়ে অনেকেই আমার পশ্চাৎপদে বংশদন্ড ব্যবহার করেছেন।

এটা অস্বীকার করছি না। বাঁশ খেতেই হচ্ছে। আবার বিশ্বাসও করতে হচ্ছে। সমস্যা হলো অন্য জায়গায়। আজকাল সবাই বাঁশ হাতে করেই বন্ধুত্ব করছেন। সুযোগ বুঝে তার সদ্বব্যবহার করে লাভবান হচ্ছেন।

বিপুল উৎসাহ নিয়ে হাতখানা মেলে ধরেছিলাম গণকসাহেবের সামনে। হাত দেখানোর এই বিষয়টিতে আমার কোন কালেই বিশ্বাস ছিল না। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচাল, হর্ষ-বিষাদের সংশয়াপন্নতা, তারুণ্য- বৃদ্ধতার সন্ধিক্ষণে ভালোবাসা খুঁজে পাবার মোহেই এই হাত বাড়ানো।

আমাজন বনের নদীগুলোর মত হাতের রেখাগুলো। গুপ্তধন খুঁজে পাবার মত করে গণকসাহেব অভিযান চালালেন। রেখার উৎপত্তি থেকে সমাপ্তি, হাতের এপাশ ওপাশ কিছুই বাদ দিলেন না। নানাভাবে বিচরণ শেষেই প্রথমেই বাঁশ খাবার উক্তি করলেন তিনি।

  • মেয়েছেলে বা নারী ঘটিত সমস্যা আছে আপনার! আবারও গম্ভীর মুখে থেকে ততোধিক গম্ভীর বাক্য। কিছুটা শ্লেষ মেশানো শব্দ
    নাকমুখ দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ও স্বস্তির নি:শ্বাস দু’টোই বের হয়ে এলো। পুরুষ আমি, নারী সাথে বা নারীঘটিত ঘটনা থাকবে না, এটা অস্বস্থিকর। পুরুষ হিসেবে দাবী করার একটা বিষয় আছে না! তবে স্বস্তির সুবাতাস বয়ে যাবার কোন ঘটনা গত দু’দশক আসেনি।

যার সাথে ঘটানোর চেষ্টা করেছি বা করার চেষ্টা করছি, সফল হচ্ছে না। অথচ যেখানে কোন কিছু নেই, সেখানে দূর্নামের শেষ নেই। এটা ঘট্ছে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গীর দোষে। তবে পুরুষ ঘটিত ঘটনা নাই, এটা অনেক স্বস্তির।

এবার তাঁর গম্ভীর মুখের আকাশে প্রথম চাঁদের মত একচিলতে হাসি। তবে গলার স্বর আগের মতই গম্ভীর।

  • বিয়ের আগে কড়া প্রেম ছিল বা পরকীয়াও থাকতে পারে।
    আমিও মৃদু হেসে মনে মনে আমার প্রেমের ইতিহাস ঘাটতে শুরু করলাম। আরে! প্রেম তো শুরু হয়েছিল সেই অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময়। বাংলা ছায়াছবির কালজয়ী তিন নায়িকা ববিতা, কবরী ও শাবানা রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। বগুড়ায় খালার বাসায় বেড়াতে যাবার অযুহাতে কিছু টাকা হাতে পেতাম। শেষরাতে কয়েকটা পান্তা মুখে হেঁটে দিয়ে ২১ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে বগুড়া। ভাড়ার টাকায় সিনেমার টিকিট।

গার্লস স্কুলের মেয়েদের কার হাসি শাবানার মত, কারটা ববিতার মত তা ছিল আমাদের গবেষণার বিষয়। ধীরে ধীরে বড় হতে লাগলাম। নায়িকাদের হাসি মন থেকে মুছে যেতে লাগলো, আশে পাশের মেয়েরাই নায়িকা হয়ে গেল। আমিও নায়ক হয়ে গেলাম। ডিফারেন্ট টাচ্ এর সেই গান তখন লিখা হয় নি, অথচ সেই গানই অন্তর দখল করে আছে। ‘মন কি যে চায় বল, যারে দেখি লাগে ভাল……। ‘রূপালী সৈকত’ সিনেমায় জয়শ্রী কবিরের হাসি মেয়েদের মাঝে খুঁজে বেড়ানোর বৃথা চেষ্টা। পঞ্চাশোর্ধ্ব এই জীবনে আমি এখনও নায়কের মত প্রেমময়, নায়ক হয়ে উঠা বন্ধ হয়নি। কড়া জ্বাল দেয়া ঘিয়ের মতই আমার প্রেম কড়া। চলুক না এ জীবন উত্তাল প্রেমসাগরে নৌকা ছুটিয়ে। ফরিদা পারভীনের সেই গানটা এখন পাথেয়- নিন্দার কাঁটা যদি নাই ……… প্রেমের কি স্বাদ আছে বল’।
হৃদয়ের কাহিনী ছেড়ে গণকসাহেব এবার আমার শরীর নিয়ে শুরু করলেন। এবার কিছুটা চিন্তিত স্বরে বললেন- আপনার পাকস্থলী বা মলদ্বারের সমস্য থাকতে বা হতে পারে। ভাইরে ভাই! পাকস্থলীর জন্যই তো জীবন। কর্মের সকল সংগ্রাম এই পাকস্থলী কে ঘিরে। জীবনের অধিকাংশ সময় ও অর্থ ব্যয় হয়, পাকস্থলী বা উদর পূর্তির জন্য।

এটার সমস্যা তো থাকবেই বা হবেই। তাছাড়া বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি চাঁদে যাবার রকেটের চেয়েও বেশী। একবেলা যদি খাদ্য গিলতে পারি, সেটা কমপক্ষে ৩দিন পাকস্থলীতে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চলে। সুতরাং এই প্রচেষ্টার ফলস্বরৃপ পাইলস বিনা দাওয়াতে মলদ্বারে বেড়াতে আসবে, এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

গণক সাহেব আবারো আমার হৃদয়ের পাড়ায় বেড়াতে এলেন। হৃদয়ের কষ্ট লাঘব বিষয়ে হালকা ইঙ্গিত দিলেন। বললেন-আপনার হৃদয়ে যে কষ্ট আছে, তা ভবিষ্যতে থাকবে না। অট্টহাসিতে কথাটি উড়িয়ে দেবার ইচ্ছাটা অনেক কষ্টে দমন করলাম। হৃদয়ের কষ্ট কত প্রকার ও কি কি, আমার ঠোটস্থ। যে কোন সময় একদমে বলতে পারি বা লিখে দিতে পারি। একশ তে একশ পাব। এই তো কয়দিন আগে হালকা দাদাগিরি করতে গিয়ে ৪২ দিনের একটা কষ্ট হৃদয়ে শ্যওলার মত জমে গেছে।

কষ্ট ভবিষ্যতে কমে আসবে এটা কল্পনাতীত। কষ্টের কোন অংশ কমবে? কমিয়ে দেবার জন্য কে হাত বাড়াবে? কষ্ট কমে আসুক এটা কে না চায়। আমিও চাই, আমি অনেক বেশী বেশী করে চাই। বাড়ানো হাতটি যদি আবারও আগের হাতগুলোর মত কষ্ট দেয়? কষ্ট বাড়িয়ে দেয় যদি? থাক কষ্ট কমানোর দরকার নেই। প্রেমের সাথে সাথে কষ্টগুলো গলাগলি করে জীবন জুড়ে থাক।

কষ্টের চিন্তার মাঝে ডুবে ছিলাম। হঠাৎ গণক সাহেবের গম্ভীর গলা সব চিন্তা ছিন্নভিন্ন করে দিল। সেই গম্ভির স্বরের সাথে দু:খ জড়ানো কন্ঠে বললেন- আপনি তো সংসার জীবনে বড়ই অসুখী। আমার মুখের বত্রিশ উইকেট অল আউট! সংসারই নাই, তার আবার সুখী অসুখী কি? হালকা দুষ্টমীতে পেয়ে বসলো। সুখ-অসুখ বুঝার জন্য সংসার শুরু করবো নাকি!! কার সাথে? কেউ কি তার আপন শক্তিতে এই জীবন নৌকার হাল ঘুরিয়ে দেবে? নাকি একাকীই! একবাও মেলে না, দুই বাও মেলে না………।
Loneliness and the feeling of being unwanted is the most terrible poverty.

ছবি: আমেরিকার গ্রান্ড ক্যানিয়নে রেড ইন্ডিয়ানদের ঘরের ভেতর থেকে আকাশ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top